সাইফউদ্দীন আহমেদ লেনিন: নিজের জন্য কখনও ভাবেননি। নিজের জন্য কিছু করেনওনি। তার সবটুকুই ছিল মানুষের জন্য। মানুষকে নিয়েই যত ভাবনা ছিল তার। কাছের, দূরের, আত্মীয়, অনাত্মীয় সবার উপকারেই লেগেছেন তিনি।
অতি সাদা মনের মানুষটি নরেশ চন্দ্র রায়। কিশোরগঞ্জের অতি পরিচিত মুখ ছিলেন একসময়। মাথায় গান্ধী টুপি, মুখে সদা হাসি, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি খাটো গড়নের এই মানুষটিকে দেখে সকলেই চিনতে পারতো। ছোট বড় প্রায় সব শ্রেণি পেশার মানুষের কাছেই তিনি নরেশ দা। কিশোরগঞ্জ শহরের খড়মপট্টি এলাকার সেই নরেশ দা আজ শুধুই স্মৃতি।
কারও মেয়ে বিয়ে দিতে অর্থ সংকট, কেউ রোগী নিয়ে সমস্যায়, তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন; এমন যে কারও বিপদে নরেশ রায় ছিলেন ‘সাক্ষাত ভগবান’। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে টাকা যোগাড় করে তবেই ফিরতেন তিনি। সবটুকুই বিলিয়ে দিতেন অসহায়দের মাঝে। নিজের ঘরের চুলায় আগুন জ্বলবে কিনা, সে চিন্তা তার কোনদিনই ছিলনা। কিন্তু অন্যের ঘরের চুলায় আগুন ধরাতে দিন রাত ছুটেছেন তিনি। শ্মশানে কারও মরা নিতে হবে, কিংবা গোরস্থানে লাশ, সবার আগে ছুটতেন নরেশ রায়। পূজামণ্ডপে যেমন যেতেন, ঈদগাহ আর মিলাদ মাহফিলেও ছিল তার অগাধ যাতায়াত। হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়েও আপাদমষ্তক ছিলেন অসাম্প্রদায়ীক চেতনার মানুষ। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সাথেও ছিল তার মধুর সম্পর্ক। দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটি স্বপ্ন দেখতেন একটি সুখী, সমৃদ্ধ, শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার। নিজের বা নিজের পরিবারের কথা ভাবেননি, এমনকি দেশ ছেড়ে ভারতে নিজের মা, ভাই, বোন ও আত্মীয়দের কাছে চলে যাবার কথাও কখনও ভাবেননি। যে দেশের আলো বাতাসে বড় হয়েছেন, যে মাটির ঘ্রাণে পরান জুড়িয়েছেন, তার কাছে সেই দেশ আর মাটি ছিল স্বর্গের চেয়েও দামি। আমৃত্যু এই মাটি আকড়ে থেকেছেন তিনি।
আজ প্রায় ১৩ ধরে এই মানুষটি আমাদের মাঝে নেই। ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাতে সকল মায়া ত্যাগ করে পরলোকে পাড়ি জমান পরোপকারী এই মানুষটি। কাছের কিংবা উপকারভোগী কেউ এখন আর তাকে স্মরণ করেনা। তার স্মরণে হয়না পুষ্পার্ঘ অর্পন কিংবা প্রদীপ প্রজ্জ্বলন। দূর আকাশে নক্ষত্রের মতই আলো ছড়াচ্ছেন তিনি।