সাইফউদ্দীন আহমেদ লেনিন: কারবালার শোকাবহ ঘটনার আবহে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে ১৬১ বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে পবিত্র আশুরা। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও নানা আনুষ্ঠানিকতায় পরিপূর্ণ ছিল অষ্টগ্রামের “কারবালা” ময়দান। ১ মহরম নিশান উত্তোলন করে শুরু হয়ে ১০ মহরম তাজিয়া মিছিলের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান।
মহরমের চাঁদ দেখার পর অর্থাৎ ১ মহরম থেকে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। হাবেলিবাড়ির ইমামবাড়ায় লাল ও কালো নিশান উত্তোলন, ফজর নামাজের পর জারি, মাতম মার্সিয়া, রোজা রাখা, নিরামিষ জাতীয় সাধারণ মানের খাবার গ্রহণ, খালি পায়ে থাকা ও মাটিতে শয়ন, তবারক বিতরণসহ নানা রকম শোকানুষ্ঠান চলে। মূল অনুষ্ঠান হয় ৯ ও ১০ মহরম। ৯ মহরম দুপুর ১২ টা ১ মিনিটে এবং রাতেও ১২ টা ১ মিনিটে ইমাম হোসাইনের রোহানী ফয়েজ হাসিলের উদ্দেশ্যে হাজারো ভক্ত, মুরিদ হাবেলিবাড়ির ইমামবাড়ায় গাস্ত (প্রদক্ষিণ) দিয়ে থাকে। এই শোকানুষ্ঠানে অষ্টগ্রামের হাজারো সুন্নী মুসলমান হোসাইন প্রেমিকগণ ঐতিহাসিক হাবেলিবাড়ির হোসাইনী মোকামে জমায়েত হয়ে “হায় হোসাইন, হায় হাসান” ধ্বনিতে অশ্রুবিসর্জন করে থাকেন। ১০ মহরম তাজিয়া মিছিলের মধ্য দিয়ে স্থানীয় “কারবালায়” গিয়ে সমাপ্তি হয় অষ্টগ্রামের আশুরা অনুষ্ঠান।
একই অবস্থা চলে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের অর্ধশত ইমামবাড়ায়। শুধু তাই নয়, একই নিয়মে মহরম পালিত হয় কিশোরগঞ্জের ভৈরব, হোসেনপুর, ভাগলপুর ও বৌলাই এলাকায়, নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ি ও মদন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল ও নাসিরনগর, হবিগঞ্জের সুলতানশী হাবেলিসহ প্রায় ১০১ গ্রামে। এছাড়া সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ আরো অনেক এলাকাতে একই নিয়মে মহরম পালন করে থাকে।
জানা গেছে, অষ্টগ্রামে সুন্নীদের মধ্যে মহরম অনুষ্ঠানের প্রধান প্রবক্তা হলেন হযরত শাহজালাল (রহ.) এর সহচর সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রহ.) এর ১৩ তম বংশধর জোয়ানশাহী পরগণার নয়কোষা জমিদারী ত্যাগী ভাটির অলী হিসেবে খ্যাত হযরত সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী (রহ.), যিনি ‘সৈয়দ আলাই মিয়া সাহেব’ নামে বেশী পরিচিত। তার প্রধান বাক্য উক্তি ছিল “গুরু শিস্য লোভী কামী, উভয় নরকগামী” এবং “ভোগে নয় ত্যাগেই খোদা প্রাপ্তি হয়“। তিনি জমিদারি ত্যাগ করে একটি জীর্ণ কুটিরে অবস্থান করে স্রষ্টার ধ্যান সাধনায় মগ্ন থাকতেন। তিনি হোসাইন প্রেমে সর্বদা মুহ্যমান হয়ে ভক্তদের হোসাইন প্রেমে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। যে স্থানটি স্থানীয় কারবালার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, এর ৯৬ শতক জায়গা সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতি (রহ.) ওরফে সৈয়দ আলাই মিয়া কর্তৃক দানকৃত। এখানকার ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতি (রহ.) আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হওয়ায় আনাদায়ী খাজনার দায়ে ১৮৩৬ সালে ন‘কোষা জমিদারি‘ বিলুপ্ত ঘোষণা হয়। কালক্রমে অষ্টগ্রামের ‘দেওয়ান বাড়ির‘ নাম পরিবর্তন হয়ে হাবেলিবাড়ি বা হাওলিবাড়ি হিসেবে পরিচিত লাভ করে। হাবেলিবাড়িকে কেন্দ্র করে প্রায় ১৬১ বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে শোকাবহ আশুরা অনুষ্ঠান।
এ বিষয়ে হাবেলিবাড়ির সন্তান অষ্টগ্রাম সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ ফাইয়াজ হাসান বাবু বলেন, অষ্টগ্রামে প্রায় ১৬১ বছর ধরে অষ্টগ্রামে মহরমের শোকানুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে। এই শোকানুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা শহিদগণের প্রতি সম্মান ও মিথ্যার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে থাকি। মহরম মানুষকে ধৈর্য, ত্যাগ ও ন্যায়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করে। আশুরা উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে সুশৃঙ্খলভাবে ১০ দিনব্যাপী মহরমের শোকানুষ্ঠানের সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করায় পাঁচ ইউনিয়নের হোসাইনীপ্রেমিক ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।