নিউজ একুশে ডেস্ক: সৈয়দ মীনা উরফে সৈয়দ সুলতান (রহ.) আনুমানিক ১৫৫০–১৬৪৮ খ্রি. মধ্যযুগীয় মহাকবি, সুলতানশী আদি সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. এর সুযোগ্য উত্তরসূরী ঐতিহাসিক সুলতানশী হাবেলীর প্রতিষ্ঠাতা ইসলামী রেনেসাঁর অন্যতম দিশারী। খ্যাতিমান সাধক, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগীয় মহাকবি সৈয়দ মীনা উরফে সৈয়দ সুলতান রহ. কাহিনীকাব্য ও শাস্ত্রকাব্য রচয়িতা হিসেবে পরিচিত। বাংলা ভাষার উপর বিশেষ দখল ছিল তাঁর। তিনি একাধারে ফার্সী ও উর্দু ভাষায় কাব্য রচনা করেন, অন্যদিকে তরফের শাসকও ছিলেন।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার (প্রাচীন তরফ রাজ্যের রাজধানী) লস্করপুর হাবেলীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সৈয়দ মুসা (রহ.) এর কনিষ্ঠ ভ্রাতা, পরিণত বয়সে স্বপরিবারে দিল্লীতে রাজ পরিবারের আদলে বসবাস করতেন।
১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ শাহ মুসা’র হারানো রাজত্ব আরাকান পতি‘র সহযোগিতায় পুনরায় ফেরত পাওয়ার পর দুই ভাইয়ের মধ্যে বিভিন্ন কারণে মনোমালিন্য দেখা দেয়। তখন সৈয়দ সুলতান রহ. লস্করপুর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে একটি বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে বসবাস শুরু করেন। যার ফলে দুই ভাগে বিভক্ত হয় ‘তরফ রাজ্য‘।
নবনির্মিত সেই বাড়িতেই সাহিত্য চর্চার মধ্যদিয়ে শেষ জীবন কাটিয়ে দেন তিনি। বহু পরমার্থ বিষয়ক সঙ্গীত রচয়িতা, তাঁর রচিত ‘জ্ঞান প্রদীপ গ্রন্থে ‘গভীর সাধনতত্ত্ব‘ আলোচিত হয়েছে। তাঁর বাংলা ভাষায় রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্য হলো ‘নবীবংশ‘, ‘জ্ঞানপ্রদীপ ও জ্ঞানচৌতিশা‘, ‘জয়কুম রাজার লড়াই‘ এবং ‘শবে মেরাজ‘। ধারণা করা হয় ১৫০০ সালের শেষভাগে রচিত হয় ‘শবে মেরাজ গ্রন্থটি‘।
‘নবীবংশ’ কাব্যে ভাষার সৌন্দর্য ও ভাবের মনোহারিত্বের কারণে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক কাব্যটিকে ‘ম্যাগনাস ওপাস’ (Magnus Opus) বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি আরও বলেন, ‘ইহা বিষয়–বৈচিত্র্যে ও আকারে সপ্তকাণ্ড রামায়ণকেও হার মানিয়েছে‘। পনের হাজারেরও বেশি পঙক্তি সম্মৃদ্ধ নবীগণের কাহিনী নির্ভর ‘নবীবংশ (দ্বিতীয় খণ্ড) কাব্য কাহিনী সমাপ্ত করেছেন শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত এসে।
সৈয়দ মীনা উরফে সৈয়দ সুলতান (রহ.) তিন পুত্র সন্তানের জনক ছিলেন। সৈয়দ শাহ গোয়াস (রহ.) উরফে কিবরিয়া (মসাজান আদি), সৈয়দ শাহ ইউনুছ (রহ.) (সুলতানশী হাবেলী) ও সৈয়দ শাহ জিকরিয়া (সুলতানশী হাবেলী)।
সৈয়দ সুলতান (রহ.) এর অধনস্থ পুরুষরা জ্ঞানচর্চা ও আধ্যাত্মিক সাধনায় গৌরবোজ্জ্বল অবদান রাখেন। এই বংশে অগণিত জ্ঞাণী, গুণী, সূফী, দরবেশ, পীর–ফকির, কবি–সাহিত্যিক, সমাজ ও কওমের খেদমতগার জন্ম নিয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রে রেখেছেন উল্লেখযোগ্য অবদান। সৈয়দ সুলতান (রহ.) এর বংশধরগণ পরবর্তীকালে সুলতানশী থেকে ত্বরিকত ও বৈবাহিক সূত্রে বিভিন্ন স্থানে গমন করেন। তাঁরা মসাজান, দাউদনগর হাবেলী, হিয়ালা সাহেববাড়ি, চন্দ্ৰচুড়ি সাহেববাড়ি, কুমিল্লা সৈয়দবাড়ি, রূপসা জমিদারবাড়ি, কুমিল্লা রূপসা হাউস, গোবিন্দ শ্রী সৈয়দ বাড়ি, হয়বতনগর দেওয়ান বাড়ি, হয়বতনগর মাস্টার সাহেববাড়ি, অষ্টগ্রাম হবেলী বাড়ি (হাউলি বাড়ি), ভাগলপুর দেওয়ানবাড়ি ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাস স্থাপন করেন। সৈয়দগণ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লেও সবার সাথে সবার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। প্রত্যেকটি বাড়ি স্ব স্ব এলাকার ইতিহাসে প্রসিদ্ধ স্থান।
মহাকবি মধ্যযুগের সাধক, সৈয়দ সুলতান (রহ.) এর নামানুসারে অদ্যাবধি নবনির্মিত বাড়িটি সুলতানশী হাবেলী নামে পরিচিত। সৈয়দ সুলতান (রহ.) এর তিন পুত্রের একজন হলেনঃ সৈয়দ শাহ জিকরিয়া (রহ.) তার পুত্র সৈয়দ শাহ আহমদ (রহ.) তারপুত্র সৈয়দ শাহ ফাত্বাহ (রহ.) তারপুত্র সৈয়দ শাহ আছির (রহ.) তারপুত্র সৈয়দ শাহ নাজির (রহ.) তারপুত্র সৈয়দ শাহ নাতির (রহ.) তারপুত্র সৈয়দ শাহ সাবের (রহ.)।
হযরত সৈয়দ শাহ সাবের (রহ.) শিক্ষা–দীক্ষা রিয়াযত‑রিয়াছত সব কিছুই সাধিত হয় তার পিতা আধ্যাত্মিক পুরুষ সৈয়দ নাতির (রহ.) সাহেবের একান্ত তত্বাবধানে। পুর্ব–পুরুষের ধারায় তিনি যেমন প্রখ্যাত জমিদার ছিলেন, তেমনই আধ্যাত্মিক শিক্ষক ও সাধক ছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে সংসারি মনে হলেও মূলত ছিলেন সংসার বিবাগী। তিনি নিজ পিতার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ত্বরিকতের কাজের আঞ্জাম দিয়েছেন।
এই বুজুর্গ জীবন যাপন করতেন অত্যন্ত সাদা–সিধে। তাঁর ধর্মানুরাগ ও জ্ঞান গরিমায় মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তার কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সাংসারিক জীবনে কিশোরগঞ্জ জেলার পূর্ব–দক্ষিণে অবস্থিত অষ্টগ্রাম দেওয়ান বংশের আদি পুরুষ দেওয়ান মনোয়ার খাঁ প্রকাশ আজদর খাঁ বংশের মেয়ে নয় কোষা জমিদার ‘চাঁন বিবি‘ সাহেবার (স্বামী) দেওয়ান নূর হায়দর দম্পতির একমাত্র কন্যা জিন্নৎচাঁন বিবিকে বিবাহ করেন। তাঁর ঔরষে তিন পুত্র যথাক্রমে সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতি ওরফে আলাই মিয়া, সৈয়দ আব্দুল রহিম আল–হোসাইনী চিশতি ওরফে মলাই মিয়া ও সৈয়দ আব্দুল আজিম আল–হোসাইনী চিশতি জলাই মিয়া। তন্মধ্যে সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতী ওরফে আলাই মিয়া ও তাঁর ছোট ভাই সৈয়দ আব্দুল আজিম আল–হোসাইনী চিশতী জলাই মিয়াকে সঙ্গে করে নানার বাড়ি অষ্টগ্রাম নয় কোষা জমিদার বাড়ি (অষ্টগ্রাম হবেলি) তে স্থানান্তর হন।
সৈয়দ আব্দুল করিম হোসাইনী চিশতি ওরফে আলাই মিয়া (রহ.) (১২১৪–১৩০৯ বঙ্গাব্দ)
সুলতানশী হাবেলী থেকে অষ্টগ্রাম নয় কোষা জমিদার বাড়িতে বাসতিঃ বাংলাদেশের যে সব যুগ শ্রেষ্ঠ আউলিয়াগণ ভাষা, ধর্ম, স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষ প্রাধান্য বিস্তার করে ধন্য হয়েছেন, তন্মধ্যে হযরত সৈয়দ শাহ আবদুল করিম আল–হোসাইনী (রহ.) উরফে সৈয়দ আলাই মিয়া সাহেব ছিলেন অন্যতম। ভাটির অলী বলে খ্যাত এই মহান সাধক ১২১৪ বঙ্গাব্দে ঐতিহাসিক সুলতানশী হাবেলীতে জন্মগ্রহণ করেন। নয় কোষা জমিদার চাঁন বিবির কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় উত্তরাধিকার সূত্রে ‘জমিদার চাঁন বিবি‘ সাহেবার পরে তাঁর দৌহিত্র সৈয়দ আব্দুল করিম উরফে আলাই মিয়া সাহেবের হাতে চলে আসে জমিদারীর দায়িত্ব। তিনি পাক–পাঞ্জাতনের প্রতি খুবই উদগ্রীব, উৎসাহিপ্রাণ ছিলেন। জমিদারিত্ব রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি তাঁর কোনো খেয়াল ছিল না। তিনি সর্বদাই ঐশী প্রেমে বিভোর ও বিমোহিত হয়ে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। জমিদারীর কোনো খোঁজ খবর রাখতেন না, ফলে জমিদারিত্ব ক্রমান্বয়ে বিনষ্ট হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৮৩৬ সালে ইংরেজ সরকার অনাদায়ী বকেয়া খাজনার দায়ে জমিদারী বাজেয়াপ্ত করে। সৈয়দ আলাই মিয়া তখন সংসার ত্যাগ হয়ে বাড়ির সামনে একটি জীর্ণ স্থানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দিনাতিপাত করতেন। পরবর্তিকালে ধর্মীয় সাধক হিসেবে তাঁর খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার প্রধান উক্তি ছিল ‘ত্যাগের ভিতরই খোদা প্রাপ্ত হয়, ভোগের ভিতরে নয়‘।
‘গুরু শিষ্য লোভী কামী উভয় নরকগামী‘। তিনি জমিদার বাড়ির আঙ্গিনায় (হাবেলীবাড়ি) স্থাপন করেছিলেন একটি ইমামবাড়া। সেই থেকে (আনুমানিক উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে) অষ্টগ্রাম ও আশেপাশের এলাকায় পবিত্র মহরমকে কেন্দ্র করে ‘অষ্টগ্রাম হাবেলী বাড়িতে পবিত্র আশুরার অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে।
সৈয়দ আলাই মিয়া সাহেবের দুই পুত্র ও এক কন্যা ছিল। পুত্র সৈয়দ নওয়াব মিয়া সাহেব ও কন্যা বাল্যকালে পরলোক গমন করেন। অপর পুত্র সৈয়দ আবুল হাশিম ওরফে লাল মিয়া সাহেবকে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার ভাগলপুর দেওয়ান বাড়ির জমিদার দেওয়ান আহমদ রেজা সাহেবের কন্যা আকিকুন্নেছাকে বিবাহ করে ভাগলপুর দেওয়ান বাড়িতেই বসতি স্থাপন করেন।
সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) ওরফে সৈয়দ আলাইমিয়া সাহেবের নিকট হিন্দু, মুসলমান, স্বাক্ষর, নিরক্ষর, খান্দানী, অ–খান্দানী লোক তার ধর্মানুরাগ ও জ্ঞান গরিমায় মুগ্ধ হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেই ওলিকুল শিরোমনি দেহ ত্যাগের পূর্বাপর অসংখ্য কেরামত ও গুণাবলী প্রবীণদের মুখে এখনও শোনা যায়।
১৩০৯ বঙ্গাব্দের ১৮ বৈশাখ (২২ মহরম) তিনি পরলোক গমন করেন। ঐতিহ্যবাহী অষ্টগ্রাম হাবেলীতে তাঁর মাজার রয়েছে। প্রতি বছর পবিত্র আশুরা ও ২২ মহরম বাৎসরিক ওরস শরীফ মহা সমারোহে উদযাপিত হয়। সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতী ওরফে সৈয়দ আলাই মিয়া সাহেবের জীবদ্দশায় অনুজ সৈয়দ আব্দুল আজিম আল–হোসাইনী চিশতী ওরফে জলাই মিয়া সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র মাওলানা সৈয়দ শাহ আব্দুল হেকীম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) কে উনার স্থলাভিষিক্ত করে যান।
সৈয়দ আব্দুল আজিম আল–হোসাইনী চিশতি (রহ.) ওরফে সৈয়দ জলাই মিয়া সাহেব ১২২৪ বঙ্গাব্দে ঐতিহাসিক সুলতানশী হাবেলীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রখ্যাত জমিদার আধ্যাত্মিক শিক্ষক ও সাধক হযরত সৈয়দ শাহ ছাবের (রহ.) ও অষ্টগ্রামের নয়কোষা জমিদার বাড়ির কন্যা জিন্নৎচাঁন বিবি দম্পতির কনিষ্ঠ পুত্র। সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতী ওরফে আলাই মিয়া সাহেব তার ছোট ভাই সৈয়দ আব্দুল আজিম আল–হোসাইনী চিশতি জলাই মিয়াকে সঙ্গে করে অষ্টগ্রাম হাবেলীতে চলে এসেছিলেন।
সৈয়দ জলাই মিয়া সাহেবও একজন কামেল বুজুর্গ ও সাধক পুরুষ ছিলেন। সৈয়দ আলাই মিয়া সাহেব জীবিত থাকাবস্থাতেই সৈয়দ জলাই মিয়া সাহেব ১২৯৯ বঙ্গাব্দের ফালগুন মাসে অষ্টগ্রাম হাবেলীতেই পরলোক গমন করেন। উনাকে অষ্টগ্রামে ‘নয়কোষা‘ জমিদারগণের পারিবারিক কবরস্থানে নানী চাঁনবিবি ও মাতা জিন্নৎচাঁন বিবির পাশে সমাহিত করা হয়। বর্তমানে যা বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণে ‘শাহ্ কুতুব মসজিদ‘ এলাকায় সংরক্ষিত রয়েছে। সৈয়দ জলাই মিয়া সাহেবের তিন পুত্র। সৈয়দ আহমদ কবির আল‑হোসাইনী ওরফে আমুদ মিয়া সাহেব (সুলতানশী), সৈয়দ রছাই মিয়া সাহেব (বাল্যবয়সে পরলোকগমন করেন) ও সৈয়দ শাহ আব্দুল হেকীম আল‑হোসাইনী সাহেব (সুলতানশী হতে অষ্টগ্রাম)।
সৈয়দ আহমদ কবির আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) ওরফে আমুদ মিয়া সাহেবের দুই পুত্র সৈয়দ আব্দুর রহিম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) ওরফে ডুগা মিয়া সাহেব (সুলতানশী), দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ আব্দুন নঈম লাল সাহেব (অষ্টগ্রাম হাবেলী), তিনি অষ্টগ্রাম সদর ইউনিয়নের টানা প্রায় ৩০ বছর চেয়ারম্যান ও আমৃত্যু অষ্টগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
সৈয়দ আব্দুল হেকীম (সুলতানশী হতে অষ্টগ্রাম হাবেলী)
১২৯৪ বঙ্গাব্দে সৈয়দ আব্দুল হেকীম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) ঐতিহাসিক সুলতানশী হাবেলীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৪/৫ বছর বয়সে পিতৃহীন হন। পরবর্তীতে বড় চাচা সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) ওরফে আলাই মিয়া সাহেবের তত্ত্বাবধানে লালিত–পালিত ও শিষ্যত্ব গ্রহণ করে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। ১২–১৪ বছর বয়সে পিতৃতুল্য বড় চাচা সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) ওরফে আলাই মিয়া সাহেব ইহলোক ত্যাগ করায় পুনরায় সৈয়দ আব্দুল হেকীম সুলতানশী হাবেলীতে চলে যান। পরবর্তী সময়ে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক ‘বৌলাই সাহেব বাড়ী‘তে ভগ্নীপতি সৈয়দ আজিজুল হক সাহেবের কাছে চলে যান (সৈয়দ আজিজুল হক সাহেবও সিপাহসালার বংশধর ছিলেন)। তিনি বোনের বাড়িতে থেকেই আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে অষ্টগ্রাম হাবেলীতে চলে আসেন এবং সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) ওরফে সৈয়দ আলাই সাহেবের রেখে যাওয়া ত্বরিকতের দায়িত্ব সুনামের সাথে পরিচালনার মাধ্যমে মহরম অনুষ্ঠানের প্রচার ও প্রসার করতে থাকেন। মুরুব্বিদের মুখ থেকে জানা যায়, তিনি স্হানীয় মুরুব্বিদের নিয়ে হাওরের ফসল বপনের শুরুতে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করত: ‘হযরত শাহ কুতুব ইয়ামনি (রহ.) এর মাজার প্রাঙ্গণে চাউল, গুড় ও দুধ দিয়ে শিরনির প্রথা চালু করেন যা ‘বড় শিরনি‘ নামে পরিচিত। আজও মানুষ প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ শুক্রবার মহাসমারোহে এই ‘বড় শিরনি‘ পালন করে। আসছে।
সৈয়দ আব্দুল হেকীম সাহেব হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের বালিয়াইল সাহেববাড়িতে বিবাহ করেন। প্রথম বিবির গর্ভে কোনো সন্তানাদি না হওয়ায়, প্রথম বিবির পছন্দে অষ্টগ্রামের ইতিহাস প্রসিদ্ধ ভূঁইয়া বাড়িতে ঈশাখাঁর বংশধর জনাব ফাজিল মাহমুদ ভূঁইয়া সাহেবের কন্যা জুবেদা আক্তার খাতুনকে বিবাহ করেন। আল্লাহর কি অপার মহিমা, দ্বিতীয় বিবির গর্ভে তিন পুত্র ও দুই কন্যা জন্ম নেয়। প্রথম পুত্র সৈয়দ আব্দুল আজিজ আল–হোসাইনী মেরাজ মিয়া (বড় সাহেব) বাল্যকাল ‘বড় মা‘র কাছে বালিয়াইল সাহেববাড়িতে কাটান। তিনি অষ্টগ্রামে সরকারি ভাতাভুক্ত একমাত্র ফুটবল খোলোয়াড় ছিলেন। তিনি জাগদল ও থানা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
দ্বিতীয় পুত্র মাওলানা সৈয়দ কুতুব উদ্দিন আহমদ আল–হোসাইন চিশতী (রহ.) মাদ্রাসার পড়াশোনা শেষ করে আরবি–ফারসি, বাংলা–ইংরেজি ও উর্দুতে বিশেষ পাণ্ডিত্ব অর্জন করে প্রখ্যাত মুফতি সৈয়দ আমিমুল ইহসান (রহ.) এঁর কাছে বায়াত হয়ে ত্বরিকতের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পড়াশোনা শেষ করে অষ্টগ্রাম হোসেনিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি সুদীর্ঘকাল উপজেলা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন লেখক ও গবেষক হিসেবে দেশ বিদেশে সম্মানিত ছিলেন। তাঁর লিখিত বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে নেয়ামতে খোদা আহলে বায়াতে মোস্তফা, সত্যের মানদণ্ড ইমাম হোসাইন (রা.), আত্মার খোরাক ও প্রদীপ পাঠকমহলে বেশ সমাদৃত।
তৃতীয় পুত্র সৈয়দ হাবিবুর রহমান আল–হোসাইনী সাহেব ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের আমৃত্যু কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁর লেখা ত্বরিকতের ‘কালাম‘ এলাকায় বেশ সমাদৃত। বড় কন্যা সৈয়দা আবেদা সুলতানা বিবিকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও মোগরাপাড়া সাহেব বাড়ির সাজ্জাদানেশিন সৈয়দ মকবুল হোসেন কাদেরী এবং দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা তাহমিনা সুলতানা বাচ্চু বিবিকে সুলতানশী হাবেলীর সৈয়দ গোলাম হোসাইনী চিশতী লিলু মিয়া সাহেবের কাছে বিবাহ দেওয়া হয়।
সৈয়দ আব্দুল হেকীম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) ১৩৫৫বঙ্গাব্দে ১৯ জ্যৈষ্ঠ বাজিতপুর ঘাটে নৌকায় অজু করা অবস্থায় এক ভয়াল কালবৈশাখী ঝড়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। তাকে সৈয়দ আলাইমিয়া সাহেবের পাশেই দাফন করা হয়। প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠমাসের ১৯ তারিখ বাৎসরিক ওরস শরীফ পালিত হয়।
ঐতিহাসিক অষ্টগ্রাম হাবেলিসহ সুলতানশী হাবেলির খ্যাতনামা সন্তানরা স্ব স্ব এলাকার রাজনীতি, শিক্ষা, শান্তি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মীয় অনুশাসনভিত্তিক সমাজ নির্মাণসহ সুফিবাদ প্রচারে ব্যাপক ভুমিকা রাখছেন।
অষ্টগ্রাম হাবেলির নসব নামাঃ
ইমাম আলী ইবনে আবিতালিব (আ.)
ইমাম হুসাইন বিন আলী (আ.)
ইমাম আলী বিন হুসাইন (আ.) [যয়নুল আবেদীন]
ইমাম মুহাম্মদ বিন আলী (আ.) [ইমাম বাকের]
ইমাম জাফর বিন মুহাম্মদ (আ.) [ইমাম সাদিক]
ইমাম মুসা বিন জাফর (আ.) [ইমাম কাযিম]
ইমাম আলী বিন মুসা (আ.)
[ইমাম রেজা]
ইমাম মুহাম্মদ বিন আলী (আ.) [ইমাম তাকী]
ইমাম আলী বিন মুহাম্মদ (আ.) [ইমাম নাকী]
ইমাম হাসান বিন আলী (আ.) [ইমাম আসকারী]
ইমাম মাহদী আল মন্তাজার (আ.)
সৈয়দ আবুল ফাজল (রহ.)
সৈয়দ আবুল ফাত্তাহ (রহ.)
সৈয়দ দাউদ আ’তায়ী (রহ.)
সৈয়দ হাসান আরাবী (রহ.)
সিপাহসালার সৈয়দ নাছির উদ্দিন (রহ.)
সৈয়দ সিরাজ উদ্দিন (রহ.)
সৈয়দ শাহ ফকির (রহ.)
সৈয়দ শাহ মুসাফির (রহ.)
সৈয়দ শাহ খোদাওন্দ (রহ.)
সৈয়দ শাহ মিকাঈল (রহ.)
সৈয়দ শাহ সুলতান (রহ.)
সৈয়দ শাহ জিকরিয়া (রহ.)
সৈয়দ শাহ আহমদ (রহ.)
সৈয়দ শাহ ফাত্বাহ (রহ.)
সৈয়দ শাহ আছির (রহ.)
সৈয়দ শাহ নাজির (রহ.)
সৈয়দ শাহ নাতির (রহ.)
সৈয়দ শাহ সাবের (রহ.)
√ তিন পুত্রঃ
১. সৈয়দ আব্দুল করিম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) আলাই মিয়া সাহেব (অষ্টগ্রাম)
√ তিন সন্তানের জনক। (এক পুত্র ও কন্যা বাল্যকালে মৃত্যুবরণ করেন।)
একমাত্র পুত্র সৈয়দ আবুল হাসিম লাল মিয়া সাহেব (ভাগলপুর দেওয়ান বাড়ির ইতিহাসে বিস্তারিত)
২. সৈয়দ আব্দুর রহিম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) মালাই মিয়া সাহেব (সুলতানশী হাবেলীর ইতিহাসে বিস্তারিত)
৩. সৈয়দ আব্দুল আজিম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) জলাই মিয়া সাহেব (অষ্টগ্রাম হাবেলী)
√ তিন পুত্রঃ
১. সৈয়দ আহমদ কবির (রহ.) আমুদ মিয়া সাহেব (সুলতানশী)
√দুই পুত্র
# সৈয়দ আব্দুর রহিম ডুগা মিয়া সাহেব।(সুলতানশী)
√ এক পুত্র * সৈয়দ রফিকুল হোসাইন √ এক পুত্র সৈয়দ সানি
(সুলতানশী)।
# সৈয়দ আব্দন নঈম লাল সাহেব (অষ্টগ্রাম) √ দুই পুত্র সৈয়দ আহমদ কবির প্রিন্স ও সৈয়দ গোলাম জিলানী লরেন্স।
২. সৈয়দ রসাই মিয়া সাহেব বাল্যকালে মৃত্যুবরণ করেন।
৩. সৈয়দ আব্দুল হেকীম আল–হোসাইনী চিশতী (রহ.) (অষ্টগ্রাম)
√ তিন পুত্র দুই কন্যাঃ
১. সৈয়দ আব্দুল আজিজ হোসাইনী মেরাজ মিয়া সাহেব।
√ এক পুত্র * সৈয়দ আব্দুস সাত্তার মঞ্জু।
২. সৈয়দ কুতুব উদ্দিন আহমদ আল–হোসাইন চিশতী
√ তিন পুত্র দুই কন্যাঃ
* সৈয়দ ফাইয়াজ হাসান বাবু √ এক কন্যা সৈয়দা নাজিবা সুলতানা ফিমা।
* সৈয়দ নিয়াজ হাসান সোহাগ (কৈশরে মৃত্যুবরণ করেন)
* সৈয়দ মোমতাজ হাসান সুজন।
√ এক পুত্র দুই কন্যাঃ
সৈয়দ গোলাম সফতাইন দাইয়্যান, সৈয়দা তাতমীন জাহান সাবিকা, সৈয়দা সাহেবা।
৩. সৈয়দ হাবিবুর রহমান আল–হোসাইনী হবিব মিয়া সাহেব।
√ এক পুত্রঃ সৈয়দ রাকিবুল হাসান শাহান।
√ এক পুত্রঃ সৈয়দ আরহাম হোসাইনী।
তত্ত্বপ্রমাণ পুঞ্জিঃ
* তরফের সৈয়দ বংশ ও প্রাসঙ্গিক কথা, লেখক সৈয়দ মাহমুদুল হক।
* সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রহ.), লেখক ডক্টর এস এম ইলিয়াস।
* হযরত শাহজালাল (রহ.), লেখক দেওয়ান নুরুল আনোয়ার।
* তাওয়ারিখে ঢাকা, লেখক মুন্সি তায়েফ।
* তরফের ইতিকথা, লেখক সৈয়দ হাসান ইমাম।
* নোট অনদি এন্টি কুয়িটিস অফ ঢাকা, লেখক সৈয়দ আওলাদ হোসেন।
* বাংলা একাডেমি ফোকলোর সংকলন ৪৯ সমিক্ষক, মোঃ সাইদুর।
* ময়মনসিংহ গেজেটিয়ার্স।
* সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রহ.) ইন্সটিটিউশন।
* অষ্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য, লেখক আবুল কাশেম।