আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মুফাচ্ছির, মুহাদ্দিছ, মুফতি, নাছেহে জামান, মুছলেহে উম্মাহ, মুজাদ্দিদে জামান, ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ৩০ বছরের ইমাম, হয়বতনগর এ.ইউ. আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ, ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদ ও বড় বাজার শাহাবউদ্দিন মসজিদের সাবেক খতিব, পীরে কামেল হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ নূরুল্লাহ (রহ.) পরলোক গমন করেন ২২ নভেম্বর’২০০৬ খ্রি.। এই মহান আলেমে দ্বীনের সংক্ষিপ্ত জীবনী সার্বজনীন পাঠকের জন্য।
নাম ঠিকানা জন্ম মৃত্যু: হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ নূরুল্লাহ (রহ.), পিতা-মরহুম মাওলানা কাজী মোহাম্মদ শাহনাওয়াজ, মাতা-মরহুমা মোছা. ফায়জুন্নেছা ফাতিমা, তিনি “বায়তুন্নুর” ১০২৮ বেগম রোকেয়া সড়ক, শোলাকিয়া, কিশোরগঞ্জ, বাংলাদেশ এই ঠিকানায় বসবাস করতেন, পৈত্রিক নিবাস “কাজী বাড়ি” গ্রাম ও ডাকঘর- পাঁছদরিল্লা, উপজেলা- নান্দাইল, জেলা-ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ। তিনি ১৪ আগস্ট ১৯৩৯ খ্রি. সোমবার কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার দগদগা গ্রামে তার নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন, ২২ নভেম্বর ২০০৬ খ্রি. বুধবার ঢাকা বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার জানাজা ২৩ নভেম্বর’০৬ খ্রি. বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জ ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। সমগ্র দেশ অবরোধ অবস্থায়ও জানাজায় লক্ষাধিক মুসল্লী অংশগ্রহণ করেন। পৈত্রিক নিবাসে তার প্রতিষ্ঠিত নূরে এলাহী জামে মসজিদ সংলগ্ন “জান্নাতুল খুলদ” কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
শিক্ষা জীবন: তিনি ঢাকা মাদ্রাসা-ই-আলীয়া হতে কামিল ফিকাহ, কামিল হাদিস ও কিশোরগঞ্জ আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়া মাদ্রাসা হতে দাওরায়ে তাফছির এবং কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ হতে স্নাতক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম.এ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষায় পারদর্শি ছিলেন।
তার ধর্মীয় চেতনা: পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে বিদআতকে পরাভূত করতে আমরণ জিহাদ করেছেন। তার সমগ্র জীবনে চিন্তা চেতনায় সার নির্যাস ছিল “ত্বরীকায়ে রাছুলুল্লাহ (সা.) দর্শন”। জামায়াতে আহলে কোরআন ওয়াচ্ছুন্নাহপন্থী ছিলেন। এ বিষয়ে স্বাধীনতাত্তোর সময়ে ঢাকায় পুরাতন সংসদ ভবনে ওআইসি আয়োজিত সম্মেলনে বক্তৃতা করেন তিনি।
ত্বরিকার বায়াত: হযরত মাওলানা মুফতি সৈয়দ আমিনুল ইহসান এর নিকট থেকে ১৯৬১ খ্রি. দ্বীনি ত্বরিকায় বায়াত হন। ১৯৮৮ খ্রি. হযরত মাওলানা আবুল আনছার আবদুল কাহার সিদ্দিকী ফুরফুরা হতে খিলাফতপ্রাপ্ত হন।
কর্মময় জীবন: উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক কিশোরগঞ্জ শোলাকিয়া ঈদগাহ এর ইমাম হিসেবে ১৯৭৫ খ্রি. হতে ২০০৩ খ্রি. পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ খ্রি. হতে ১৯৭৭ খ্রি. পর্যন্ত ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ খ্রি. হতে ২০০৩ খ্রি. পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ বড়বাজার শাহাবুদ্দিন জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ খ্রি. হতে ২০০৪ খ্রি. পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ হয়বতনগর এ.ইউ. আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও এর পূর্ব সময় ১৯৬৩ খ্রি. হতে মুহাদ্দিস এর দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ১৯৭২ খ্রি. হতে ১৯৭৭ খ্রি. পর্যন্ত কিশোরগঞ্জ আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন এবং স্বাধীনতাত্তোর সময়ে মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি তা খুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, শুধুমাত্র হাদিস বিষয়ে তার ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা দশ সহস্রাধিক।
তার লিখিত গ্রন্থ: তিনি ১৯৬১ খ্রি. হতে লিখতে শুরু করেন। আরবিতে ৪১টি, উর্দুতে ২৫টি, ইংরেজিতে ১টি, বাংলায় ৬৫টিসহ সর্বমোট ১৩২টি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে ফাজায়েলে মেছওয়াক, কোরবানি ও আক্বীকার ইতিহাস, ওয়াহী উচ্ছিয়াম (রোজার ওয়াহী), ইসলামের দৃষ্টিতে মুছীবাত, চিকিৎসা ও মৃত্যু, আদর্শ বিবাহ (ইসলাম ও যৌবন বিজ্ঞান), ফাযায়েলে নিয়াতি মাকবূল (ইসলামী দর্শন), ফাযায়েলে দোয়া, স্বপ্নে রাছুলুল্লাহ (দ.) (নবী দর্শন), আছারুন্নাবী (দ.) (নবীজীর পত্রাবলী), ফাযায়েল ও মাছায়েলে দরূদ ও ছালাম, তাফছিরে নূরে আল্লাহ, ত্বরীকায়ে রাছুলুল্লাহ (দ.) (শাজারা), শরীয়ত, এলেম, ঈমান, পবিত্রতা, ত্বরীক্বত, হকীক্বত, মারেফত, বায়আত ও যিকরুল্লাহ), কোরআন পাঠের আদব কায়দা এই গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হয়েছে। অন্যান্য গ্রন্থগুলো প্রকাশের অপেক্ষায় আছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেভাবে খ্যাতি লাভ করেন: সৌদি আরবের জেদ্দা ভিত্তিক “ওজারাতুল ইলাম”এর আহুত ১৯৭৭ খ্রি. ইসলামী ফিকাহ্ বিষয়ে, ১৯৭৮ খ্রি. ইসলামী ইতিহাস বিষয়ে, ১৯৭৯ খ্রি. ইসলাম ও অন্যান্য বিষয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে সৌদি আরব সরকার কর্তৃক পুরস্কার হিসেবে অর্থ ও সম্মান অর্জন করেন।
তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সমূহের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি: ১৯৮১ খ্রি. হয়বতনগর এ.ইউ.আলীয়া মাদ্রাসায় এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কামিল, ফিকাহ, তাফছির, আদব বিভাগ ও হেফজুল কোরআন, মোজাব্বির-ই-মাহিব ও বিজ্ঞান বিভাগ চালু করেন। ১৯৭৯ খ্রি. কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে প্রথমবারের মতো নূরুল উলুম আদর্শ মহিলা মাদ্রাসা ও বালিকা এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৫ খ্রি. কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে প্রথমবারের মতো এস.ভি.সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মহিলাদের ঈদের জামাত চালু করেন এবং মহিলাদের জুমার নামাজ আদায়ের পক্ষে ফতোয়া দেন। তার পৈত্রিক নিবাস ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার ৬নং রাজগাতি ইউনিয়নের পাঁছদরিল্লা গ্রামে “কাজী বাড়ি” সংলগ্ন তাদের পারিবারিক সম্পত্তি দান করে ১৯৮০ খ্রি. শাহনাওয়াজ ছফিরিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা, ১৯৮৬ খ্রি. নূরুল উলুম ফাইজুন্নেছা ফারকুন্দা বালিকা মাদ্রাসা ও এতিমখানা এবং ১৯৮০ খ্রি. নূরে এলাহী জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও কিশোরগঞ্জ জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, খানক্বাহ, দাতব্য চিকিৎসালয়সহ শতাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা: কিশোরগঞ্জের নেতৃস্থানীয় আলেম ও ওলামা মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এক অনুকরণীয় ও সাহসী ভূমিকা রেখে ভাস্বর হয়ে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার পৈত্রিক নিবাস “কাজী বাড়ি” পাক হানাদার বাহিনী আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে স্বাধীনতাত্তোর সময়ে কিশোরগঞ্জ আল-জামিয়াতুল ইমদাদিয়া মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে গেলে ‘ইসলাম’ প্রসারের কথা চিন্তা করে তিনি মাদ্রাসাটি খোলার উদ্যোগ নেন এবং সফলকাম হয়ে চালু করে দায়িত্ব পালন করেন।
হজ্ব ও ওমরা পালন: ১৯৮১ খ্রি. তিনি ফরজ হজ্ব আদায় করেন। এ সময়ে জাবালে রাহমাতে আছরের নামাজে ইমামতি করার সৌভাগ্য হয় তার। এছাড়াও তিনি ১৯৯৪ খ্রি. বদলী হজ্ব ও ১৯৯৬ খ্রি. রমজানুল মোবারকে বরকতের জন্য হারামাইনে ওমরা, রোজা, তারাবীহ, তাহাজ্জুদ, এতেকাফ ও আল্লাহর ধ্যানে সময় অতিবাহিত করেন। উল্লেখ্য, সৌদি আরব সফরের সময়ে সৌদি রেডিওতে তার সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়।
পিএইচডি গবেষণা: হযরত মাওলানা আবুল খায়ের মোহাম্মদ নূরুল্লাহ (রহ.) এর জীবন ও কর্ম নিয়ে এমফিল ও পিএইচডি গবেষণা হচ্ছে।
মৃত্যুদিন উপলক্ষে কর্মসূচি: আল্লামা আবুল খায়ের মোহাম্মদ নূরুল্লাহ (রহ.) ’র ২২ নভেম্বর-২০২৩ খ্রি. মৃত্যুদিনকে সামনে রেখে গত ১৭ নভেম্বর ২০২৩ খ্রি. শুক্রবার কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন মসজিদে বাদ জুমা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। ২২ নভেম্বর-২০২৩ খ্রি. বুধবার তার প্রতিষ্ঠিত শাহনেওয়াজ ছফিরিয়া আলিম মাদ্রাসা ও ফাইজুন্নেছা ফারখুন্দা দাখিল মাদ্রাসার যৌথ উদ্যোগে নূরে এলাহী জমে মসজিদে তার জীবনীর ওপর আলোচনা, মিলাদ, দোয়া ও তার কবরস্থান জিয়ারতের কর্মসূচি। ২৩ নভেম্বর-২০২৩ খ্রি. বৃহস্পতিবার শাহনেওয়াজ ছফিরিয়া এতিমখানা ও ফাইজুন্নেছা ফারখুন্দা এতিমখানার ছাত্র/ছাত্রীদের কর্তৃক কোরআন খতম, দোয়া ও কবর জিয়ারত এবং মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে এতিম ছাত্র/ছাত্রীদের মাঝে খাবার বিতরণ। ২৪ নভেম্বর-২০২৩ খ্রি. শুক্রবার মরহুমের প্রতিষ্ঠিত নূরে এলাহী জামে মসজিদে বাদ জুমা দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, কবর জিয়ারত এবং মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে মুসল্লীদের মাঝে তবারক বিতরণ। (প্রেস বিজ্ঞপ্তি)