ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) সংবাদদাতা: কিশোরগঞ্জের ভৈরবে দুই সন্তান রেখে টাকা–স্বর্ণালংকার নিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাননি গৃহবধূ আকলিমা বেগম। বরং শাশুড়ি ও ননদ নির্যাতন করে দুই সন্তান রেখে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে আদালতে মামলা করেছেন ওই গৃহবধূ আকলিমা বেগম।
কিশোরগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং ২ এ আকলিমা তার লিবিয়া প্রবাসী স্বামী হোসেন মিয়া (৩৫), দেশে থাকা শাশুড়ি হালিমা বেগম (৫৮) ও ননদ পহেলা বেগমকে (৩২) আসামি করে মামলাটি দায়ের করেন বৃহস্পতিবার।
স্বামীর হুকুম ও প্ররোচণায় শাশুড়ি ও ননদ তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন বলে মামলায় উল্লেখ করেন তিনি। আদালতের বিচারক অভিযোগটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে ভৈরব থানার অফিসার ইনচার্জকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত রবিবার গৃহবধূ আকলিমার শাশুড়ি ও ননদ প্রবাসী স্বামীর হুকুমে তার ঘরে প্রবেশ করে দুই সন্তানের সামনে তাকে মারধর করেন। এক পর্যায়ে ঘরে থাকা স্বর্ণালংকার ও টাকা নিয়ে দুই শিশু সন্তানকে রেখে আকলিমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন।
আজ শুক্রবার বিকালে ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি ইউনিয়নের গোছামারা গ্রামের বাবার বাড়িতে স্থানীয় সাংবাদিকদের গৃহবধূ আকলিমা জানান, তার স্বামী হোসেন মিয়া একজন জুয়াড়ি। সৌদি আরব থাকাকালীন জুয়া খেলার অপরাধে তার স্বামী সে দেশের পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। পরে তার কফিল ছাড়িয়ে আনলেও, আকামা আটকে দেওয়া হয়। তাই তার বাইরে যাওয়া ও কাজ কর্ম বন্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তিনি পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে জেল খেটে খালি হাতে দেশে ফেরেন ২০১৮ সালে।
দেশে এসে স্ত্রীর স্বর্ণালংকার ও জমি বিক্রি করে ভৈরবের হাজী মার্কেটের পেছনে একটি কনফেকশনারী দোকান দেন। কিন্তু এক বছরের মধ্যে তিনি জুয়া খেলে ব্যবসা নষ্ট করে ফেলেন। ২০১৯ সালের শুরুতে সংসার চালাতে আকলিমা একটি বিউটি পার্লারের দোকান দেন। কিন্তু কয়েক মাস পর মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে পার্লারটি বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় বন্ধ হয়ে যায় সংসারের আয় রোজগার।
সে সময় স্বামীর ব্যক্তিগত চাহিদা ও সংসারের ব্যয় মেটাতে কয়েক দফায় তিনি বাবার বাড়ি থেকে ৩/৪ লাখ টাকা এনে দেন। এত কিছুর পরও স্বামীর নির্যাতন বন্ধ হয়নি। সে সময় জুয়ার আসর থেকে তার স্বামীকে পুলিশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করে। সেখান থেকে ছাড়িয়ে আনতেও তাকে অর্থ ব্যয় করতে হয়।
২০২০ সালে বাবার বাড়ি থেকে আড়াই লাখ টাকা এনে জুতার ব্যবসা দিয়ে দেন। কিন্তু জুয়া খেলে সেই ব্যবসাও তিনি নষ্ট করেন। ইতোমধ্যে ৮ মাসের বাসা ভাড়া বাবদ ৮০ হাজার টাকা আটকে যায়। সংসার চালানোর মতো টাকাকড়ি না থাকায় আবারও বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে তার ওপর নির্যাতন এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। সে সময় একবার রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যান তিনি। কিন্তু বাবার বাড়িতে অতিষ্ঠ পিতা তাকে উল্টো শাসন করলে তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। ঘটনাটি বাড়ির লোকজন দেখে ফেলে এবং আহতাবস্থায় উদ্ধার করে চিকিৎসা করানো হয়। পরে সন্তানদের অজুহাতে তাকে আবারও স্বামীর সংসারে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসলেও তার প্রতি স্বামীর এতোটুকু সহানুভূতি ও মমতা জাগ্রত হয়নি। বরং কিছু দিন যাবার পর আবারও বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দেওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু হয়। এরমধ্যে নতুন বায়না তার লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার। অগত্যা বাবা–ভাই–বোন ও ভগ্নিপতির কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা যোগাড় করে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে স্বামী হোসেনকে লিবিয়া পাঠানো হয়।
বর্তমানে ডাঙ্গি (লিবিয়া থেকে ইতালি যাবার প্রক্রিয়া) বন্ধ থাকায় তিনি ইতালি যেতে পারছেন না। ফলে মোবাইল ফোনে স্ত্রী এবং তার বাবার বাড়ির লোকজনদের গালিগালাজসহ নানাভাবে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। হোসেন মিয়া দেশে থাকা তার মা ও বোনকে নানা কথা বলে ক্ষেপিয়ে তুলে তার ওপর নির্যাতন করাচ্ছেন বলে আকলিমার অভিযোগ।
সবশেষে গত রবিবার তার ঘরে থাকা কিছু নগদ টাকা স্বর্ণালংকার জোর করে নিয়ে যান শাশুড়ি ও ননদ। এদিন ৪টি খালি চেকের পাতা ও খালি স্ট্যাম্পে তার স্বাক্ষরও নেন জোর করে। পরে বাসা থেকে তাকে জোর করে বের করে দিলে তিনি বাবার বাড়িতে গিয়ে উঠেন। ঘটনার ৪/৫ দিন পর তার দুই সন্তান দাদি ও ফুফুর কাছ থেকে পালিয়ে গিয়ে তার সাথে মিলিত হয়। তিনি ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে সুবিচার প্রার্থনা করেন।
এদিকে আকলিমার বড় বোন রত্না বেগম জানান, তিনি আকলিমার স্বামী হোসেন মিয়ার বড় ভাই জাকির মিয়ার স্ত্রী। তার স্বামী ও হোসেন এক সাথে সৌদী আরব থাকতেন। তিনি খুব সখ করে তার বোনকে দেবরের সাথে বিয়ে দেন। এরই মাঝে তাদের সংসারে একটি মেয়ে ও একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়।
কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই জুয়া খেলায় জড়িয়ে হোসেন বদলে যেতে থাকে। বোনের সংসার টিকিয়ে রাখতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সবশেষ হোসেন লিবিয়া যাওয়ার সময় তার স্বামীর অগোচরে একটি এনজিও থেকে তিনি ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করে দেন।
রবিবার আকলিমাকে ভৈরব শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসা থেকে তাদের শাশুড়ি ও ননদ নির্যাতন করে বের করে দেন। পরে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের করলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। এ নিয়ে শাশুড়ি ও ননদের সাথে বিবাদ হয় তার। গত বুধবার তাদের অত্যাচার ও মারধরের শিকার হয়ে তিনিও তার তিন সন্তানসহ বর্তমানে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
আকলিমার বৃদ্ধ বাবা আব্দুস সালাম জানান, প্রায় ১৭ বছর আগে উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের টান কৃষ্ণনগর গ্রামে ছাদেক মিয়ার ছেলে জাকির মিয়ার সাথে আমার বড় মেয়ে রত্মা বেগমকে বিয়ে দেই। তাদের সুখের সংসার দেখে এবং মেয়ে ও জামাতার অনুরোধে ছোট মেয়ে আকলিমাকে হোসেনের সাথে বিয়ে দেই। কিন্তু মেয়ের জামাইয়ের সর্বনাশা জুয়ার নেশা তাদের সংসারটাকে তছনছ করে দিয়েছে। টাকার জন্য আমার মেয়েটার ওপর বার বার নির্যাতন করেছে জামাই। কয়েক দফায় কয়েক লাখ টাকা দেওয়ার পরও আমার মেয়ের সুখ হয়নি। বন্ধ হয়নি নির্যাতন।
তিনি আরও অভিযোগ করেন, আমার অপর এক জামাইয়ের কাছ থেকে ধার এবং আমার স্ত্রীর অলংকার বিক্রি করে হোসেনকে লিবিয়া পাঠিয়েছি। সেখানে গেছে দুই মাসও হয়নি। ইতালির ডাঙ্গি না হওয়ায় এবং লিবিয়ায় তার কাছে আরও তিন লাখ টাকা পাঠানোর জন্য আমার মেয়েটাকে ফোনে গালিগালাজ করছে জামাই। এদিকে জামাইর কথা শুনে দেশে তার মা ও বোন আমার মেয়েটার ওপর নির্যাতন করে বের করে দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছে থানায়। এতে আমার মান সম্মান আর কিছুই বাকি থাকলো না। আমি এর বিচার চাই।
এর আগে গত সোমবার শাশুড়ি হালিমা বেগম পুত্রবধূ আকলিমার বিরুদ্ধে ভৈরব থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। ওই অভিযোগে বলা হয় আকলিমা দুই সন্তানকে বাসায় রেখে আব্দুল আল খালিদ নামের এক যুবকের সাথে পালিয়ে গেছে। প্রবাসী স্বামীর অনুপস্থিতে তারা দুজন প্রেম করে এঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।