নিজস্ব প্রতিবেদক: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, আজকে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যাশা করছে, তাদের প্রিয় দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি জনগণের সমর্থন নিয়ে আগামীতে সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশার বাংলাদেশ গড়ে তোলার কাজ করবে বিএনপি।
তিনি সোমবার বিকালে কিশোরগঞ্জ পুরাতন স্টেডিয়ামে জেলা বিএনপি আয়োজিত এক বিশাল গণ সমাবেশে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্যে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, আমরা একটি পর্যায় অতিক্রম করে এসেছি। যে পর্যায়টা ছিল স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে দেশের মানুষকে মুক্ত করা। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে বলেই সকল বিপদ কেটে যায়নি। এখনো সামনে বিপদ আছে। আমাদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এর পাশাপাশি আমাদেরকে দেশ গড়ে তুলতে হবে। দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। দেশকে সামনে নিয়ে যেতে হবে। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে একটি সম্ভাবনাময় দেশ, একট সম্বাবনাময় জাতি হিসেবে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই সকল কিছু হয়ে যায়না। রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আমদেরকে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামেও জয়যক্ত হতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের আন্দোলনের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।
তারেক রহমান বলেন, শহীদ পরিবারের সদস্যদের সম্মান জানানোর জন্য আজ আমরা একত্রিত হয়েছি। একটি শঙ্কামুক্ত পরিবেশে আমরা একত্রিত হয়েছি। এই সময়টার জন্য বিগত ১৭ বছর এই দেশের মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে, আত্মত্যাগ করতে হয়েছে, সংগ্রাম করতে হয়েছে, প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয়েছে। এই কিশোরগঞ্জ জেলাতেই আমরা ১৭ জন মানুষকে হারিয়েছি, যারা আত্মত্যাগ করেছেন এদেশের মানুষের অধিকারের জন্য। ১৬ জন মানুষ শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যারা ভয় পাননি, পিছিয়ে যাননি মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে। সারা বাংলাদেশে এরকম হাজারো মানুষ আছেন, হাজারো শহীদ ও তাদের পরিবার আছেন, যারা আত্মত্যাগ করেছেন বিগত ১৭ বছরে। বিশেষ করে বিগত জুলাই-আগস্ট মাসে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে শুধু ঢাকা শহরেই। এর বাইরে বহু মানুষ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বিএনপিরই শুধু ৬০ লক্ষের মত নেতাকর্মী নির্যাতিত হয়েছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন। বিএনপির বাইরে আরো রাজনৈতিক দল আছে, যাদের সদস্যরা বিএনপির নেতাকর্মীদের মত অত্যাচারিত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন।
এই যে এত মানুষ শহীদ হয়েছেন, এত মানুষ আত্মত্যাগ করেছেন, এত মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন, কেন এই মানুষগুলো আত্মত্যাগ করেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন? কারণ একটাই, এই মানুষগুলো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। আমরা যে আজ মুক্ত পরিবেশে কথা বলতে পারছি, এরমক একটি মুক্ত পরিবেশের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল এই মানুষগুলো। কিন্তু আমরা দেখেছি স্বৈরাচার দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল বাংলাদেশের মানুষকে। এই বাংলাদেশের মানুষ দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা গুলির সামনে নিজেদের বুক পেতে দিতে রাজি। তারপরও বাংলাদেশের মানুষ স্বৈরাচারকে মেনে নিতে রাজি না। সেজন্যই হাজারো মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা এই বাংলাদেশকে পেয়েছি। একাত্তর সালে যেমন লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, আবারো ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে আমরা এই দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে স্বৈরাচারকে বিদায় করতে সক্ষম হয়েছি জনগণের সংগ্রামের মাধ্যমে, গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
তারেক রহমান বলেন, এই যে আত্মত্যাগ, এই যে বিসর্জন এটিকে আমাদের ধরে রাখতে হবে। এদের মূল্য আমাদেরকে দিতে হবে। আজকে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ একটি নতুন প্রত্যাশা নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ যে প্রত্যাশা নিয়ে বিগত পতিত স্বৈরচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। ১৯৭১ সালে যেভাবে মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন, সামনের বাংলাদেশ তৈরির জন্য, একটি মানবিক বাংলাদেশ তৈরির জন্য, যে বাংলাদেশে মানুষ মুক্তভাবে কথা বলতে পারবে, যে বাংলাদেশে মানুষ তাদের রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে, যে বাংলাদেশের মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারবে, সেই বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে।
স্বৈরাচারের পতন হওয়ার পরও স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা এখনো দেশে রয়ে গেছে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, আমরা বার বার বলেছি, আবারো বলছি, আজকে লাখো জনতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই সরকার জনগণের রাজনৈতিক যে প্রত্যাশা, জনগনের রাজনৈতিক যে অধিকার যার জন্যে বিগত ১৭ বছর ধরে মানুষ সংগ্রাম করেছে, সেই অধিকার যাতে সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তার জন্য তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কিন্তু এটিও সতর্কভাবে খেয়াল রাখতে হবে, তারা জনগণের এই কাজটি করতে গিয়ে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজ করতে গিয়ে এমন কোন পরিস্থিতির উদ্ভব যেন না হয়, যাতে করে স্বৈরাচার আবার কোন ষড়যন্ত্র করার সুযোগ পায়। স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা সুযোগ পেলে তারা তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখবে।
গণতন্ত্রের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দল ও প্রতিটি মানুষকে সতর্ক থাকার এবং একইভাবে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করারও আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি এই বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। শুধু প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব। যদি আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে সঠিক মানুষগুলোর হাতে এই দেশ এবং জাতির নেতৃত্ব তুলে দিতে সক্ষম হই, এদেশের মানুষকে যদি আমরা সুযোগ করে দিতে পারি, সঠিক ব্যক্তিবর্গ এই জাতিকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারবে। এই নেতৃত্বের মাধ্যমে এই দেশের মানুষ একদিকে যেমন রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, একইসাথে অর্থনৈতিক মুক্তিও অর্জন করা সম্ভব।
তিনি বলেন, সমগ্র বাংলাদেশ যেমন একটি সম্ভাবনাময় দেশ, ঠিক একইভাবে আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা একটি সম্ভাবনাময় এলাকা। কিশোরগঞ্জকে একটি সম্ভাবনাময় জেলা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বোরো মৌসুমে এখানে প্রচুর ধান হয়। এখানকার হাওরে যে ধান উৎপন্ন হয়, সেটা সমগ্র বাংলাদেশের ১৬ শতাংশ। যদি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হয়, যদি কৃষকদেরকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহযোগিতা প্রদান করা যায়, তাহলে ১৬ শতাংশকে আমরা হয়তো ২০ থেকে ২৫ শতাংশে উন্নীত করতে সক্ষম হবো। এখানে যে বিশাল হাওর আছে, এই হাওরে বিভিন্ন প্রকারের মাছ উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের মিঠা পানির যে চাহিদা এই মাছের চাহিদার বিশাল ভাণ্ডার হচ্ছে এই এলাকা। বিদেশে এই মাছ কেন আমরা রফতানি করতে সক্ষম হবোনা। গার্মেন্ট শিল্পের পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ যদি বছরে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়, মৎস্যচাষীদেরকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সঠিক সহযোগিতা করা যায়, তাহলে মাছ রফতানি করেও বাংলাদেশকে পরিচিত করে দিতে পারবো বিশ্বের দরবারে।
সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এত গুম, খুন, লুটতরাজ করার পরও ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারেক রহমানের নির্দেশে আমাদের নেতাকর্মীরা শান্ত থেকেছে। আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করি। এটা আমাদের দুর্বলতা নয়। তিনি আরো বলেন, স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, কিন্তু জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনো। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। দলকে শক্তিশালী করতে হবে। সুশৃঙ্খল থাকতে হবে। এতদিন যেমন একটি আদর্শকে সামনে রেখে আন্দোলন করেছি, সামনেও আমাদেরকে সেই আদর্শ সমুন্নত রাখতে হবে।
সমাবেশে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এডভোকেট ফজলুর রহমান বলেন, শত শত শহীদের রক্তে এই দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে। হাসিনা পালিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ নির্বংশ হয়েছে। দেশনেতা তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা নতুন করে দেশকে গড়ে তুলবো।
দ্রত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবি করে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ভোট চলবে ভোটের মত, সংস্কার চলবে সংস্কারের মত। আগামীর বাংলাদেশ হবে তারেক রহমানের বাংলাদেশ।
কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরীফুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ ওয়ারেস আলী, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, কিশোরগঞ্জ জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি এডভোকেট জালাল উদ্দিন, জেলা বিএনপির সহ সভাপতি রুহুল আমিন আকিল, ইসমাইল হোসেন, এডভোকেট শরীফুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ সোহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক ইসরাইল মিয়া, আমিনুল ইসলাম আশফাক প্রমুখ। সমাবেশে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের কয়েকজন সদস্যও বক্তব্য রাখেন।
সভাপতির বক্তব্যে শরীফুল আলম বলেন, দেশ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে ঠিকই৷ কিন্তু স্বৈরাচারের দোসরমুক্ত হয়নি। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নির্দিষ্ট কিছু সংস্কার করে ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বৈরাচারের দোসরদেরকে ঠাই দেওয়া হবেনা। ষড়যন্ত্র করতে দেওয়া হবেনা।
সমাবেশে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে কিশোরগঞ্জের শহীদ ও আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।
সমাবেশ সঞ্চালনা করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পদক মাজহারুল ইসলাম।